কবিতার স্ক্র্যাপবুক
আল শাহারিয়া
নেমেছে আফ্রোদিতির রূপে নেমেসিস
মিথ্যে প্রতিশোধের গোলাপে অমৃত যোগ‚
এই বিদীর্ণ দেহ হচ্ছে বিদীর্ণ আরও
দেখি বেঁচে থাকায়ও আছে অনুযোগ।
ঘৃণা
আমি কি আমার জন্মকে ঘৃণা করছি?
মহাপৃথিবীর একই গ্রহে জন্মেছি, একই ভূ-খণ্ডের শস্যে-তৃণে-মৎসে বেড়ে উঠেছি বলে মন-মগজে ধর্ম-সমাজ-দর্শন যুদ্ধ চলছে অবিরত।
নেহাতই রক্তপাতহীন এসব যুদ্ধ যে খুব একটা অর্থবহ নয় এটা স্পষ্ট।
এ থেকে সম্ভবত ঘৃণার সীমারেখার দূরত্ব ঢের!
আমি কি আমার রক্তকে ঘৃণা করছি?
সমবর্ণের রক্তস্রোত আজ এক অবাক বিষ্ময়।
অথর্ব গণতান্ত্রিক এই দেশে রক্তের কোনো বিনিময়প্রথা চালু নেই,
এর পিঠাপিঠি জন্মেছে কিছু
প্রাণোচ্ছল
নির্ঘুম
রাত্রিযাপন।
অথচ, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে বোধহয় অ্যাপোলো!
আমি কি ঘৃণাভরে দেখছি নিজের দেশকে?
যে সার্বভৌমত্বের জোরে নিজেকে বাংলাদেশী বলি, সেখানেই খোলা-বুকে সহস্র বুলেট তার বসতি গড়ছে।
অগনিত অনিয়ত বুলেটের বেড়াজালে আবদ্ধ আমি—
শুধু নৈঃশব্দে স্তব করছি, 'এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না, এই জল্লাদের উল্লাস মঞ্চ আমার দেশ না।'
একে নিশ্চয়ই দেশের প্রতি ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ বলা চলে না!
সম্ভবত এসব অর্থহীন স্নায়ু-মৈথুনকেও তুমি ঘৃণা বলতে পারো না!
আয়ুপথ
বুকের ভেতর একটা নির্জন গ্রাম নিয়ে
শহরমুখী পায়ে বাসা বাঁধে একই কল্পিত প্রজনন,
যে মেয়েটি আমায় চুমু খেত দু'বেলা নিয়ম করে
ওর ঠোঁটের গন্ধ লেগে আছে ফেলে আসা শৈশব জুড়ে।
ফেলে আসা কী সত্যিই যায়,
ফেলে আসা যায় কী স্পর্শ, সময়, চাঁদ-রাত-জোনাকি, মাঝরাতের স্টেশন, ক্রোশ-ক্রোশ পথ বা ঘুম ভাঙানো রেল-ক্রসিং?
সম্ভবত যাপিত জীবনের সব অনুসঙ্গ, প্রতিটি ফুল-পাখি-পাতা, চা-সহ কাপ, মাশরুম হওয়ার স্বপ্ন, বিকেলবেলার ডেট আমি সাথে নিয়ে হাঁটছি।
শুধু হাঁটছি না, হাঁটছি, দৌড়াচ্ছি, হামাগুড়ি দিচ্ছি।
এইসব স্বতঃস্ফুর্ত সংগ্রহের ভারে মাঝেমাঝে নতজানু হই, স্থির হই, আবার চলতে শুরু করি।
ঈশ্বর এই হাঁটা-চলা থামিয়ে দিতে পারে। কিন্তু দেয় না, কোনো ঐশী উদ্দেশ্যে।
হৃদয় ভাঙার গান(অনুবাদ)
সময়ের কার্নিশে উঁকি দেয় মন্টেরির প্রিয় স্মৃতিছায়া,
মেক্সিকোর আকাশে এখনও উড়ে বেড়ায় সেইসব ফানুস।
রিদমিক এক্যুস্টিকে বেজে ওঠে নক্ষত্রের গান,
মোহময়ী দু'টি ঠোঁট যেন রেড ওয়াইন,
ঢাকে গভীর বিষাদ যত—
যা মোহগ্রস্ত কোনো হৃদয় ভেঙেছে নিরিবলি সন্ধ্যায়;
বুঝিনি তা আমারই ছিল, বাড়ছে হৃদয় ভাঙার ক্ষত।
এই মন্টেরির-ই কোনো নির্জন ক্যাফেতে; মেরুন সন্ধ্যালোকে
স্বর্গদ্বারে শূন্যতার স্পর্শ রেখে গেছি নরক-নগরীতে,
বেপরোয়া কিছু জাগতিক রাডার এখনও খোঁজে সেই স্পর্শ,
যা সমাধিস্থ করেছি আমি নিজেই— এই মন্টেরিতে।
জীবন মূলত স্ক্র্যাপবুক—
১.
আলুথালু পথ বেয়ে নেমে যাওয়া ফুটপ্রিন্ট আমাকে নস্টালজিক করে তোলে। যতদূর চোখ যায় সবুজ ফসল, নড়বড়ে শীত কিংবা বিস্তীর্ণ জলরাশির ঢেকে দেওয়া নির্ঝঞ্ঝাট ইদ, ভোরবেলার ঘুম-ঘুম মক্তব, দুরন্ত দুপুর আর নিষেধ-বারণে মোড়া গোধুলী বিকেল। এমন এক পৃথিবী যেখানে সবাই পরিচিত। এর বাইরে যা আছে বলে জানা যায় তা— ইউক্যালিপটাস, মুখোমুখি দু'টি তালগাছ, জলরং, আর্জেন্টিনা বলে একটি দেশ রয়েছে, গাছের প্রিয় অক্সিজেন সহ আরও কত কী! ওই দু'টাকা পকেটমানি জমিয়ে উইকেন্ড উদযাপন, অসীমে উড়তে থাকা সুতো কাটা ঘুড়ি, ধানের গন্ধ, বড়শিতে মাছ ওঠা আর দাদীমার শ্লোক আমাকে আক্রান্ত করে।
২.
অতঃপর জীবনের উত্থান-পতনের শুরু। এক অদ্ভুত জায়গা। মৃদু-ব্যস্ত সবাই৷ ক্লাসের চুপচাপ ছেলেটিও টিফিন-ব্রেকে লম্বা ওভার-বাউন্ডারি হাঁকায়। মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা কম থাকায় প্রায়শই প্রাসঙ্গিক নিরবতাকে সঙ্গী করেছি। জেনেছি বন্ধুত্বের সংজ্ঞা। প্রকৃতিকেও যে প্রকৃতি হিসাবে দেখা যায় তা শেখা এখানেই। চোখ জুড়োনো মেঠোপথ, সারি সারি গাছের ডালে শালিকের সংসার, শতবর্ষী কয়েকটি বাড়ি, হেডফোনে পিংক ফ্লয়েডের 'হাই হোপস'র সাথে সন্ধ্যা নামা পথ জানান দেয় বাড়ি ফেরার তাড়া।
ছোট্ট একটা মেয়ে, নেফারতিতির পুণর্জন্ম নেওয়া একজোড়া চোখ যার দখলে। আজও জানি না জাতিস্মর কি-না তারা। সেই অব্যর্থ মুগ্ধতায় ডুবে যাওয়া ধীরে ধীরে।
৩.
সাউথ সেন্ট্রালের আকাশে তখন একরাশ ঘরবন্দী বিষণ্ণতা। শীতঘুমে গ্যাছে পুরো শহর, শুধু জেগে আছে সচেতন পিতার দুশ্চিন্তার দল। কিচেনের আড্ডা, ক্যারাম, আম্মুর হাতের খিচুড়ি, উদ্ভট বিজনেস আইডিয়া জেনারেট করা যেন রোজকার রুটিন।
কোভিড তখন হট-টপিক এই প্লানেটে। যাত্রা করলাম কবিতার কাছাকাছি। কবি, গীতিকার হওয়ার স্বপ্নের হাতছানি আমি ফিরিয়ে দিইনি, দিতে দেয়নি সমগ্রিক যাপিত জীবন।
কোভিড গেল, তবে যে বিষণ্ণতা দিয়ে গেল সেটা আর গেল না। কত কী এলো গেল, আড্ডা-ট্যুর, ক্যাম্পাস, প্রেম-পার্বণ, রকিং কন্সার্ট; কিন্তু, বিষণ্ণতা কাটানোই গেল না।
ইকারাস
আমার বাবা ডিডেলাস নয় বলেই হয়তো
আমাকে কোনো ডানা বানিয়ে দেননি স্বহস্তে।
নিজের ডানা আমি নিজেই বানিয়েছি
প্রেমের প্রলেপ আর অগণিত প্রলাপের নির্যাসে।
কিন্তু‚ একটু একটু করে যখন উড়তে শিখলাম
তখনই অনার্য সূর্যের তাপে প্রেমগুলো
গলে গলে পড়তে লাগলো আমার জীবনের কার্নিশে।
আমার ওড়ার জায়গাটাই তখন অনেকের অনির্ভরতার কারণ হয়ে উঠলো।
ফলত‚ আমি ইকারাসের মতো সময়ের অতলে পতিত প্রাণ—
হাতড়ে খুঁজছি আমার পিতাকে।
এই পিতা আমার আভিধানিক পিতা নন‚
গোত্রীয় পিতা নন‚
তবে জন্ম দিয়েছেন তো বটেই।
আমার যত প্রাচীন প্রেমিকা মিলিয়েছে মাধবীর আকাশে
তাদের চোখে উন্মনা এক আদিম মোহ দেখেছিলাম আমি।
তুমিও যখন শেষবার এসেছিলে আফ্রোদিতি, প্রেমের সফেনে ভেসে—
তোমার নির্মোহ দৃষ্টিতেও আমি মোহের চাঞ্চল্য দেখেছিলাম।
ওই যে বৈরাগ্য আমাকে ছুঁলো আর সংসার আমায় পায়নি কখনও।
এখনও আমি পাহাড়-চূড়া ছুঁয়ে থাকা দল-পালানো বেওয়ারিশ মেঘ
পুরোটা আকাশ জুড়ে ডানা মেলার স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে রই।
একজোড়া ডানার অপেক্ষায় বড়ো হই। ...বুড়ো হই!
ইকারাস 2.0
সুখ্যাতি যেন দুঃসাহসী দেয়ালে আঁকে আত্মোৎসর্গের গ্রাফিতি
যার ভিন্ন পাতায় চলে সময়, অভিশপ্ত ক্রিট
যেখানে সুদিন ফেরে সময়ের শমনে,
ফোঁটে ফুল মৃন্ময় ম্যাগনোলিয়া।
এই নেশাগ্রস্ত আবোল-তাবোল বাক্যালাপে
মাথা থেকে পালাচ্ছে দৈত্য-দানো,
সায় দিচ্ছে সুবেহ-সাদিক
শিশিরের টুপটাপে গড়ে পঙ্কিল প্রত্যুষ।
ধরো স্তব্ধ সময়, বিস্তীর্ণ জলরাশির মাঝে ছোট্ট দ্বীপ
মৃত্যুহীন জনপদ জুড়ে সবুজ ঘাস
উড়ে পেরোচ্ছি অনন্ত পথ, ফুল ও ফসিল,
ধরো ইশারা করছে শিশু ইকারাস
মুখোমুখি বসতে প্রোজ্জ্বল সূর্যের সাথে।
শোকগ্রস্ত বিকেল ঢলে পড়েছে যেন সন্ধ্যের বুকে
সাঁজোয়া বাতাস আজ শব্দ ভাসায় সুতীক্ষ্ণ ফলায়
যে দু-একটি ঝিঁঝিঁ উন্মত্ত ডেকে চলেছে অবিরাম
তাদের কেউ কেউ গড়ে তুলেছে নিহত নিকেতন।
নেক্রপলিস
মুক্ত পাখি‚ তুমিহীন এ শহর এক বিস্তীর্ণ নেক্রপলিস!
রাতের কবর থেকে উঠে দেখি স্নিগ্ধতাহীন এক অনুর্বর প্রত্যুষ‚
যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে খেলা করে একাকী বিষাদের ঘনকালো পুঞ্জমেঘ।
তোমাকে মেরে ফেলেছি আমরা; এই সভ্যতার সভ্য মানুষ।
তোমার ওষ্ঠাধর জুড়ে প্রস্ফুটিত শিমফুলে যেন থোকা থোকা দুঃখ লুকানো ছিল!
কবিতার স্ক্র্যাপবুকে চাপা পড়ে গিয়েছে আমাদের সোনালি রাত-দিন‚
হৃদয় ভরে ওঠে এক প্রাচীন নস্টালজিয়ায়‚ তোমার নিঃশ্বাস নিঃশব্দেই ম্রিয়মাণ।
তোমাকে খুন করেছি আমরা; এই সভ্যতার সভ্য মানুষ।
চারমিনারের প্যাকেট শূন্য করতে করতে দেখি
তোমার জন্য রডোডেনড্রনের কী ভীষণ অপেক্ষা!
তোমার ফিরে আসার মতো অকস্মাৎ সুসংবাদের অপেক্ষায় নতজানু অসহায়‚
মৃতপ্রায় দেহে ফুটে আছে শেষ ফুলটি— অজস্র আঘাত নিয়ে।
তোমার ফেরার পথ আটকে রেখেছি আমরা; এই সভ্যতার সভ্য মানুষ।
তোমার বসতি পুড়িয়েছি আমরাই‚ উড়িয়েছি তোমার আয়ু!
তবু‚ আকুতির স্বরে বলি‚
'ফিরে এসো মুক্ত পাখি‚ তোমার ডানায় ভর করে ফিরুক স্বাধীনতা আর অসাম্প্রদায়িকতা।'
নতজানু
বৃদ্ধ-রাতে তুমুল জ্বরের হাটা-চলা আমার শরীরে
থার্মোমিটার গুলিয়ে ফেলেছে শূন্যতম সূত্রটিও‚
তোমার হাতে মেপে দ্যাখো এই জ্বরের আধিপত্য।
দ্যাখো চা-চিনি আর উষ্ণতাহীন সন্ধ্যের মতো
নিরালা এই রাতে আমি অভিযোগহীন‚ অভিমানহীন ভালোবাসছি তোমায়‚
যদিও আমার প্রাপ্তির খাতায় ইদানীং অবিরাম শূন্যতার চাষ‚ শূন্যতার চোখে বসন্ত।
বারবার মরে যাওয়া প্রেমের ফসিল থেকে জন্মেছে এই রাত‚
এই রাত মুছে দিতে চায় জীর্ণতা সব‚ ছুঁতে চায় সবুজ।
বাড়ছে ব্যথা মেপে নাও‚ আঙুল ধরে হাঁটতে শেখাও
বিবর্ণ গ্রহের স্পষ্ট দ্রোহের অনলে পুড়ছে মন‚ পুড়ছো তুমি।
আসলেই পুড়ছো কি তুমি‚ প্রিয়তমা?
দেখেছি আলো ঝলমলে দিনে শীতল চোখে সানগ্লাস‚
তোমার বিবর্ণ ঠোঁটে লেপ্টে থাকা শুভ-মুক্তির ক্যানভাস‚
এই জলছবি এঁকে দেবে কোনো আর্বান কবি
শহুরে গ্রাফিতির অন্তঃনগরে লুকানো কবিতার লাইনে‚
তুমি বুঝে নিও সেই কবিতা‚ সূর্যের আশীর্বাদে অথবা সোডিয়াম আলোয়।
কারণ‚ 'শুধু তোমার ক্ষমতা আছে।'
যুক্তির খেলাঘর
এই যুক্তির খেলাঘরে অযাচিত মেঘ ঝরে
আলো-আশা স্থিত হয়ে যায়
এই মুক্তির প্রান্তরে‚ অনিয়ত অবসরে
ভালোবেসে শূন্যতা বয়ে যায়।
দেখি মহাশূন্য এসে জমে‚ হায়
এই আলো-আঁধারির ঠিকানায়।
অবেলায় ডাকে ভোর‚ মুখ-ছবি আঁকে তোর
ওই দিগন্তের সীমানায়
প্রিয় রাত একা হয়‚ তোর চোখে দেখা ভয়
এক প্রাচীন গল্প শোনায়।
এই অগণিত ক্যাফে‚ প্রেমের উষ্ণতা মাপে
আমার গল্পগুলো লুকানোই আছে
এই সোডিয়াম বাতি‚ জ্বলে সারা রাতি
আমার নিঃশ্বাস আঁধারেই বাঁচে‚ তাই..
আলো জ্বেলে নিভে যাই‚ কালো মেঘে অযথাই
নাগরিক বৃষ্টি নামাই।
ভুলে যাওয়া মনের কোণে‚ মন মুঠোফোনে
চেনা স্বর অচেনা হয়ে যায়
লিখে রাখি প্রিয় কবিতা‚ ভুলে যাই যদি তা
মেঘে মেঘে বেলা ক্ষয়ে যায়।
কবিতালয়
এই কংক্রিট শহর হবে কবিতার নগর
হিসেবের খাতায় জমে যাবে দিন
কত ধোঁয়ার চাদর রাখে নরম আদর
আমার এ নিথর দেহে অমলিন।
শত-সহস্র শরীর‚ অলিন্দ-নিলয়ে
হারিয়ে গ্যাছে আমার অনন্ত সুখ
এই মিথ্যা কথার বলয়ে।
আমি রাখবো আঙুল আর ভেঙে দেবো ভুল
স্বাগত আপন আলয়ে‚
আমি জ্বালাবো আগুন আর রাঙাবো ফাগুন
আগত শমন-বলয়ে।
বর্ণনাতীত অলীক কথায় সাজিয়ে কবিতার সাজ‚
তোমার যত মিথ্যে দেয়াল আমি ভেঙে দেবো আজ।
ভেঙে দেবো আজ কবিতার ঘুম
সাজানো এই রাত্রি নিঝুম..
এলোমেলো শব্দের প্রলয়ে।
সোনালি রোদ রাঙিয়ে দিলো তোমার জানালার কাচ
মিথ্যার ছায়া মিলিয়ে দিলো সোনালি রোদের আঁচ।
ভাঙিয়ে দিলো এক অচেনা ভয়
অযাচিত বিষণ্ণ সংশয়
এক দীক্ষা প্রাপ্ত মলয়ে।
মহাসময়
প্রাচীন পাখির ঠোঁটে বর্ণিল বর্ণমালায়
লিখেছে রাইম স্যামুয়েল কলরিজ
অভিমানী বৃষ্টির কাছে শূন্য নদী অসহায়
শুকনো মাস্তুল‚ নাবিকের কার্নিশ।
যে মৃত্যুর অপরিণত দূরত্বে আছে বেঁচে
সুদর্শন কবির দেশীয় হৃৎপিণ্ডের তন্তুরা
হবে সে দূরত্বের অবসান‚ সময়কে বেচে
যাবে গহীন অরণ্যে‚ ছিঁড়ে খাবে জন্তুরা।
রক্তের হ্রদে যাযাবর ক্ষুধার্ত মাংসাশী মাছ
পিরানহা- পিক্সেল কাটবে সাঁতার, চেয়ে দেখো তুমি।
ততদিনে আমি তৃতীয় স্তরের এক সুস্বাদু খাবার
মহাবিশ্বে বেঁচে খুঁজি পথ শুধু পালিয়ে যাবার।
অবুঝ শিশুর মতো সমস্ত নিষিদ্ধ-প্রসিদ্ধ ভাবনার
একটাই জানি ঠিকানা‚ তোমার ভেতর, তুমি মানলেই না।
আমি আছি মহাবিশ্বের দুর্গপ্রাচীর জুড়ে
উড়ি মহাসময়ের মহাপ্রলয়ে‚ তুমি জানলেই না।
প্রশ্ন রেখে গেলাম
আমি কেবলই নিথর চেয়ে থাকি, আদতে দেখি না কিছুই।
আমাকে রেখে গিয়েছে এক কর্পোরেট শীত,
গোছানো যৌবন আর অগোছালো কৈশোর।
ফেলে গিয়েছে অক্সিজেন, বেপরোয়া লোকাল বাস‚
সিএনজির এক্সট্রা চার্জ আর.... আর মিরপুর!
ইতিহাস হবে না এসব‚ জানি এক মামুলি দিনযাপন।
তবু‚ আমার কাছে ছিল হুট করে একটু হেসে ফেলা,
বিষাদের হ্রদে অদ্ভুত কোনো নির্বাসিত উপহার,
ছিল ঝকঝকে রোদ-বৃষ্টি দিনে সমবায় ছাতা,
শ'খানেক নয়নতারার জীবন আর একটুকরো সবুজ।
এসেছে কী এক জীবন,
এ জীবন পার করে বাড়ন্ত ক্ষত ঠোঁটের আদরে শুকায়নি।
এখনও ডানহাতি ব্যথা হুটহাট জাগে‚ যার একমাত্র গন্তব্য মৌনতা!
আমার আক্ষেপ ছিল, যার মূল্য স্বস্তির কাছে নয় বড়ো কিছু।
মানি।
যা কিছু পাই না চোখে‚ এঁকে ফেলি মনে।
যেখানে চুল বাঁধে একটিমাত্র মেয়ে।
সেও গিয়েছে চলে—
না-কি তাকে নিয়ে গেল আমার ঝকঝকে অতীত?
প্রশ্ন রেখে গেলাম...
তিমির আত্মহত্যা
আমরা সাগরতীরে বসে দেড়শো তিমির আত্মহত্যা দেখলাম অপলক,
বালুচর ভিজিয়ে অতঃপর উঠে দাঁড়ালাম।
কাল আসবো ফের,
সংখ্যা বাড়বে— আমরা জেনে গিয়েছি কষ্টেরা সংক্রামক।
আমরা দুঃস্বপ্নের মতো ভয়ংকর সময়ে পতিত,
কোনো সুখের বার্তাবাহক আমাদের ঠিকানায় আসে না বহুদিন হয়।
জনসংখ্যা হ্রাসের এই দুঃখ-স্রোতে ভেসে গিয়েছে কত নিষ্পাপ, খুনি
ঝরে যাচ্ছে কত নির্মল ফুল-পাতা।
পৃথিবীর এই দুঃখ-সুখে ঘরবন্দী নির্বাসিত কবি
প্রেয়সীর চোখে আকাশ এঁকে দিচ্ছে উড়াল।
খাবারের খোঁজে ক্ষুদ্রতাকে ক্ষুদ্র জ্ঞান করেই ছুটছে কতশত প্রাণ,
সমস্ত চাঞ্চল্যকে বিদায় বলে আজ স্থাণুবৎ বিশ্ব,
থামেনি কেবল অর্থহীন মিছিল, মিটিং, গণসমাবেশ
আর চায়ের দোকানের প্রগাঢ় সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র-উন্নয়নের রাজনীতি।
রোজ রোদ মাখা নির্মাণ শ্রমিক অপছন্দ করতো রোদের গন্ধ;
অথচ, সেই গন্ধের প্রতি আজ কী তীব্র নেশা তাঁর!
মলিন পৃথিবীর এই আম্লান দুঃখ-সাগরে ভেসে যাচ্ছি প্রতিক্ষণ
আমাদের বংশাবতংসেরা দুঃখের ভারে অন্য আলোয় হাঁটছে পথ,
সে খবর পাচ্ছি রোজ মুঠোফোনের পত্রিকায়,
চারকোণা বর্ণময় বাক্সে চোখ রেখে তন্ময়।
দুঃখ-জরায় পূর্ণ পৃথিবীতে একটুকরো স্থান কিনে নিয়ে নির্বাসিত কবি
প্রেয়সীর চোখে চেয়ে আরেকবার জন্মানোর স্বপ্ন বুনছে।
তাঁর অনুভূতির তর্জমা অনেকটা এমন—
আমাদের জাতিস্মর প্রেমে পূর্ণতা আসবে মহাকালের পথে।
মহাবিশ্বের মৃত্যুর পর তুমি-আমি আরেকবার জন্ম নেব,
অন্যকোথাও অন্যকোনো ভাষায় বলবো ‘ভালোবাসি’।
নরক নগরী
আজ সূর্য ওঠেনি‚
নরক-নগরীর নরপিশাচেরা আজ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে
ওদিকে জীবন হাতে নিয়ে থরথর কাঁপছে মানুষ
পিশাচের নখের ভয় তাদের গ্রাস করে ফেলেছে।
আমার কলোনিতে লাল-সাদা-বিবর্ণ আলো জ্বলে উঠেছে
কেউ কেউ জ্বালিয়ে দিয়েছে।
কারো কারো জানালা খোলা
তাতে চোখ রাখতেই দেখা যাচ্ছে দাউদাউ আগুনের তোড়ে
দেওয়ালে লেপ্টে গেছে শরীর—আগুন জ্বলছে।
নেকড়ের ডাক শোনা যায় নিচের তলায়
ওয়াচম্যান দায়িত্ববোধ শ্মশানে গুঁজে পরিবার বাঁচাতে মরিয়া
পুরো কলোনির সাথে কেঁপে কেঁপে উঠছে আমার ক্ষুদ্র কামরা।
আমার জানালার কাঁচ টুকরো টুকরো হয়েও
দাঁড়িয়ে আছে মিথ্যে প্রতিরক্ষায়
অথচ‚আঙুল ছুঁয়ে দিতেই শেষ টুকরোটি পর্যন্ত লাফিয়ে পড়বে মাটিতে।
চা’য়ের কাপে রক্ত, রক্তে ডিজেলের গন্ধ।
আদালত আজ খোলা হয়নি
বিচারক ঝুলে আছে ফাঁসির দড়িতে
এতো রক্তের মধ্যেও তার রক্তপাতহীন মৃত্যু।
তার রক্তের কণিকায় ভাইরাস—নেকড়ে মৃতুর ভাইরাস।
ঈশ্বর তাই রক্তপাতহীন মৃত্যু লিখেছে বিচারকের জীবন খাতায়
তার বিচারই শেষ বিচার, তার ইচ্ছাই ধ্রুব।
এই যে কবিতার আঁচড়ে আমার মৃত্যু— এটাও তার লেখা, তিনিই শ্রেষ্ঠ লেখক।
এখন বৃষ্টি এলে কি হবে?
হঠাৎ রোদ উঠে গেলে নেকড়েরা চলে যাবে?
সূর্য কি মেঘের কাছে অসহায়?
নাকে যে রক্তের ঝাঁঝালো গন্ধ পাচ্ছি‚
প্রশ্বাসে জীবাণু টেনে নিচ্ছি বুকের ভিতর‚
ধুঁকে ধুঁকে মরছি রোজ
কে দায়ী এর জন্য? সূর্য না-কি মেঘ?
হয়তো মেঘ!
মেঘ চাইলেই এই শহর-নগর ভিজিয়ে দিতে পারে অবলীলায়।
এখন আর ‘নো ম্যানস্ ল্যান্ড’ বলে কিছু নেই
হয়তো নেকড়েরা সব সীমানা মুছে দিয়েছে।
ছোট্ট একটা পৃথিবীর কীসের আবার সীমানা!
এ-তো শিশিরবিন্দু ছাড়া কিছুই নয়।
মানব বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে পচে মরছে—
এই শহরের কিছুতেই তাদের নজর নেই।
অথচ তাদের এতো ব্যাস্ততা—যেন নিঃশ্বাস ফেলার অবসর নেই!
তবু, রাজনৈতিক দল আছে—আছে নেতাদের পাঁয়তারা
সব মিলিয়ে দেশ-পৃথিবী এখন ভীষণ বাঁধনহারা।
সংরক্ষিত
হিমঘর থেকে বিমুক্ত হলো আমার অনাবাদি মস্তিষ্ক
ইন্দ্রিয় বুঝলো প্রশাসকের আলকেমি‚ কেনো সে বিশ্লিষ্ট।
ওখানে শ'খানেক হিমায়িত মস্তক আমি দেখেছি
ওরা বিস্বাদ এক স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিলো কবে
তাই হারিয়েছে স্বাদকুড়ি আর অনাবাদি স্নায়ুঘর।
আমরা বেড়ে উঠেছি ভিন্ন পর্বে‚ ভিন্ন গর্ভে‚ ভিন্ন কারাগারে
যেটুকু মিল পাচ্ছি বা পাবো তা প্রত্যয় ও পারাপারে।
সম্মোহন
আজ তোর ভরসাতে
রডোডেন্ড্রন রেখেছি রাইফেল সম্মুখে‚
এমন অধিকার চর্চাতে
কালো সব প্রস্থান চায় উন্মুখে।
আমার চোখের সাতটি আলো মিলেছে আকাশ নীলে
খুব আদরে সংগোপনে নীলটিকে বেছে নিলে
থমকে যাবে দ্বৈত বিকেল
কোনো প্রাচীন পাখির চোখে...
তুই চাইলে এমন বিকেল মিলিয়ে দেবো শোকে
তুই চাইলে শ্রাবণ দিনও জ্বালাবো সূর্যালোকে।
তুই কী ভীষণ বদলে গেলি শেখা নতুন কোনো বোধে
রাইফেল মুখে ফুলটি রাখি তোকে রাঙাতে আদিম ক্রোধে
বদলে যাওয়ার নিয়ম-কানুন
কেন বদলায় অলখে...
তুই চাইলে এমন স্রোতেও ভাসিয়ে নেবো তোকে
তুই চাইলে শ্রাবণ দিনও জ্বালাবো সূর্যালোকে।
আকাশ নীলে স্বপ্ন সাজাস দু’মুঠো বিকেল কিনে‚
রঙ হারানো বিকেল শেষে নিয়েছি তোকে চিনে
চিনেও আমি চিনছি না আর
তোকে একটু ছোঁয়ার ঝোঁকে...
তুই চাইলে ঘর বানাবো এই মিথ্যে কল্পলোকে
তুই চাইলে শ্রাবণ দিনও জ্বালাবো সূর্যালোকে।
আমাদের আবার দেখা হবে‚ ঠিক এখানেই
এমন পূর্ণদৈর্ঘ্য রাত জুড়ে যুগপৎ দুঃখ-সুখের এক আবেশ ছড়িয়ে পড়েছে।
সুখ বলো বা দুঃখ — দু'টোই আমার কাছে খণ্ডকালীন অতিথিমাত্র।
চলো সবুজের প্রান্তরে‚ অন্তরীক্ষেরও অন্তরে
যেখানে নদী থেমে থাকে কাশফুলের আদরে
ছায়াবীথি বুড়ো হয় পথ চেয়ে পথিকের
অর্থাৎ‚ ফিরে চলো চেনা রাস্তা ধরে
কাছাকাছি কোনো অতীতের।
চলো নীল থেকে অন্য নীলে‚
মেঘের দেশে তোমার যত বানানো ঘরে অক্লেশে
স্নানঘরে একাকীত্বের আগ্রাসী পিক্সেলে
ছুঁয়ে দেখো আমায় দ্বেষে‚ নয়তো ভালোবেসে।
অতঃপর‚ পুড়বে তুমি অতীতের শৃঙ্খল অনুতাপে।
ভেঙে ফেলো সভ্যতার এ্যান্টিক গ্লাস
ধর এ্যান্টিক গ্লাস ভেঙে কোনো জলপ্রপাত
ছুঁয়ে দিলো তোর শাশ্বত ঠোঁট‚ আমার প্রসিদ্ধ আঙুল,
সব নিষিদ্ধ চুমুর অশালীন প্রবৃত্তি।
ছুঁয়ে দিলো তোকে বলা যত ‘ভালোবাসি’
মুখ চেপে রাখা স্বাধীনতার অ্যালগরিদম
আর সাইনবোর্ডে লেখা গণতান্ত্রিক রূপকথা
তবে কি গ্লাস ভাঙার দায়ে মুক্তি দিবি আমায়?
ধর সভ্যতার অন্ধগলি জাপটে ধরলো আমাকে
নুয়ে পড়লো ফুল-পাখি-পাতা আমার মৃত্যু-শোকে
যদি পোড়ে শেষ মেঘটুকু ওই বৃদ্ধ সবিতায়
আসে মহামারি তোকে লেখা চিঠি আর কবিতায়
তবে কি প্রাচীন কবিতার শরীরে খুঁজবি আমায়?
প্রহেলিকা
আমরা চেয়ে আছি কোনো আজন্ম জ্বলতে থাকা আগুনের দিকে—
নিজেকে সম্পূর্ণ পুড়িয়ে ফেলার অমিত সাহস যার নেই,
হঠাৎ-ই আমাদের চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে
জীবন-জুড়ে নেমে আসে অমিয় বসন্ত, টের পাই—
যেন বিষণ্ণ আর্ট-গ্যালারি থেকে চুরি যাওয়া সদ্যজাত নিরবতা
মুক্তি পেয়েছে কোনো বিষাদের বহ্ন্যুৎসবে।
এমন প্রহেলিকায় জড়ানো মহাজাগতিক সময়ে আমরা হেঁটে চলেছি
একে অপরের বিপরীতে—
যোগাযোগ
এসো নির্মম সভ্যতার নির্জন এই দ্বীপে।
আমার শরীর ছুঁয়ে ছুটে যাও দিগ্বিজয়ের উন্মাদনায়
ওই কৈলাস মানসসরোবরে।
তুমি শেষবার যখন দিক পাল্টে নেওয়া পরিচিত হাওয়া হয়ে
আমাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে আলিঙ্গন করেছিলে তখন ভরা পূর্ণিমা।
আকাশে চাঁদ উঠেছিল।
এরপর আর চাঁদ, রাত, জোনাকির সাথে সংসার জমেনি আমার।
অদ্যাবধি শুধু একটা অনুভূতি অন্তঃপুরে পুষে চলেছি প্রতিক্ষণ‚
তোমাকে ভালোবাসার আগে ও পরে
তোমার মতো ভালো আমি কাউকে বাসতে পারিনি কোনোদিন।
আমার যাযাবর আর ভীষণ বেয়াড়া দর্শনে সাজানো এই জীবনে
কী অবলীলায় তুমি ফুটিয়েছো রক্তকমল,
আহত হৃদয়ে এঁকেছো অজস্র মেঘফুল,
ভাবলেই আমি শিউরে উঠি,
নতজানু হয়ে যাই তোমার সহ্যশক্তি এবং একাগ্রতার কাছে!
দেখি মহাশূন্য এসে জমা হয় তোমার চোখে।
তুমি হেসে উড়িয়ে দাও যত আদিগন্ত ব্যথা-বিষাদের ছায়া।
আমি পারি না৷ আমি কেবল ভালো থাকি তোমাকে দেখে।
উষ্ণতার দিনে তোমার চোখের তুষারকণা
আমাকে এনে দেয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দিনের মতো স্বস্তি।
তোমার চোখের কালোয় আমি হারিয়েছি পথ বহুবার।
আমি তোমার মধ্যেই ভেঙেচুরে
অজস্রবার নতুন করে আবিষ্কার করেছি নিজের অবয়ব।
আমাদের দূরত্ব বেড়েছে।
বহুদিন হয় তোমাকে আমি ছুঁয়ে দেখি না।
তবু, মনে হয় আছি পাশাপাশি,
যতটা দূরে আছি তার চেয়েও কাছাকাছি।
শেষবার সাক্ষাতের পরেও
তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছে বহুবার।
এই তো শব্দের আড়ালে তোমাকে আঁকতে গিয়ে
আবার আমাদের দেখা হলো, কথা হচ্ছে। হতে থাক নিশিদিন...
তোমাকেই প্রয়োজন
আমার চুলের শুভ্রতা ইদানীং জানান দিচ্ছে
আমার একজন উর্বর-মস্তিষ্কের নৌশালাপ-সঙ্গীনি প্রয়োজন‚
আমার প্রতিটি ক্বণিত শব্দ-সুরের অন্তরালে
যদি বিষণ্নতার রূপক খেলা করে কোনো নির্ঝর ফোয়ারার মতো‚
তবে সে তা বুঝবে‚ প্রতিবিধান খুঁজবে।
আমার এই সুদীর্ঘ একাকীত্ব জানান দিচ্ছে
আমার বর্বর যুগের সুন্দরতম প্রেমিকাকে প্রয়োজন‚
কোনো দ্বৈত-সম্পর্কের মধ্যকার হিংসা মুছে দেবে সেই অনসূয়া‚
ক্রোধে ঢেউ খেলা ঝিলে ফোটাবে রক্তকমল।
চৈত্রের বীথিকায় মৃত্যুর ঘ্রাণ পেয়ে
মাধবীর আকাশে নিভু নিভু নক্ষত্রমালার জীবনী দিয়ে
আমার মৃত্যু-শোক সে ম্রিয়মাণ করে দেবে‚ তোমরা জানবেও না —
আমার
মৃত্যু
আগাগোড়া
রহস্যময়!
এসো‚ পরিণত যৌবনা মানসী আমার‚
দেখো আমার বেঁচে থাকাটুকু চাইছে তোমায়।
সার্কাস
আমাদের অতিমর্ত্য সঙ্গমের পিঠাপিঠি চলে কয়েকশো ভ্রুণহত্যা‚ অবলীলায়...
বেদনার মতো গাঢ় হচ্ছে সময়
নিষ্ফল কিছু আহুত সবুজ‚
আয়ুরেখা ধরে ধীর পায়ে চলে
জেনেছি আমরা জ্ঞানত অবুঝ।
কয়েকশো ভ্রুণহত্যার পিঠাপিঠি চলে আমাদের অতিমর্ত্য সঙ্গম‚ অবলীলায়...
মানসী
মায়ায় নিয়েছো চোখে তুলে‚
আমি হতে চাইছি না কোনো জাতিস্মর।
তুমি কোনো অতীত মুড়ে ফেলা মানবী হয়ে
বায়বীয় প্রেম ছুঁড়ে দিয়েছো মুখবন্ধে‚
মৃত্যুর ঘ্রাণ জপে জপে আমি দেখেছি তোমায়
আমায় রাঙালে ফের জীবনের গন্ধে।
আমি ফিরতে চাই না কোনো অতীতের ভাঁজে
মানসী‚ তুমি থেকো কল্পলোকেই‚
এসো না এ অনাবাদি ধরিত্রীর দেখা চোখে
আমি চাই তোমায় চিনুক অল্প লোকেই।
প্রতিমা
প্রতারিত চোখ হ্যালোজেন বৃষ্টি চেনে না ইদানীং‚
ওদের বেওয়ারিশ এবং গন্তব্যহীন করে গিয়েছে
কাউন্ট ড্রাকুলার মতো এক রক্ত পিপাসু।
দেখি অকাল বোধন শেষে অরণ্যে রোদন
তার নিচে চাপা রাখা থাকে অজস্র অনার্য মোহ‚
যার খোঁজ মেলেনি কোনো জাগতিক রাডারে।
স্মৃতি-বিয়োগের মোহে উড়ে যাই ফানুসের দলে‚
এ মোহ ইথারের মতো অলীক জেনে
নিশিযাপন হয় কেবল স্মৃতির অবগাহনে।
সে— বারবার দল-পালানো পরিযায়ী পাখির মতো
‘অবিশ্বাস ও ঘৃণার প্রতিমা শাশ্বত’।
আত্মজীবনী
আমি বেঁচে থাকা এক রক্তকমল‚
ফুঁটে আছি অনন্ত যৌবনা এই মহাপৃথিবীর ঝিলে
আমি পথহারানো ক্যারাভান‚
তুমি আমার তীর্থস্থান— ধরিত্রী ও নভোনীলে।
সবটুকু সুখ যার অবেলার বন্ধু‚
হৃদয় দুঃখ-মেঘের আতুরনিবাস
বেঁচে থাকাই যার একান্ত অভিলাষ।
আমি বৃক্ষের ফেলে দেওয়া অবশিষ্ট
অবলীলায় কেড়ে নেওয়া জীব‚
প্রাণহীন বা ভাষাহীন নয়— কোথাও কোথাও উদ্ভিদ
তুমিই আরাধ্য আমার‚ ধৃষ্টতা কোরো ক্ষমা
তোমার কাছেই রাখি মেঘের আদর জমা..
তোমার দয়িতা সত্তা রাখছে আঙুল
মৃদু মনখারাপির হয় উচ্ছেদিত মূল।
আমি আর পৃথিবী
পৃথিবী আর আমার জন্ম একই সময়ে।
আমাদের এই আজন্ম পথচলায়
কত চোখ ঝলসানো চাকচিক্য দেখেছি;
বিচিত্রিতায় ডুবে যেতে দেখেছি নিমেষেই।
পৃথিবীর ফুসফুসে জমছে রোজ মৃত লাশের আর্তনাদ,
একমাত্র আমিই তা শুনি।
আমার নরক-বাসরে সতীর্থ কাউকে পাবো বলে এখনও আমি ভাবি না;
তবে‚ পৃথিবী এমন সতীর্থদের পেয়েছে
যারা নিজেদের সাথে অবলীলায় ওকে নিয়ে নরকে পাড়ি জমাবে।
শতাব্দী পার করেও আমি অনাবিষ্কৃত এক গ্রহ;
যার জাজ্বল্যমান কণা তোমাদের চোখে দেখা সম্ভব হয়নি।
কালো রুমাল চোখে বেঁধে খুন‚ মিথ্যা‚ ধর্মীয় গোঁড়ামি‚ ধর্ষণ
আর আমার জন্য অদৃশ্য অবহেলাকে
স্বাভাবিক ভেবেই নিয়ে চলেছো নিঃশ্বাস।
আমার সন্তানকে বলেছিলাম‚ “তুমি মানুষ হও”!
জবাবে সে অসম্মতিসূচক ‘না’ ছাড়া কিছুই আমাকে বলেনি।
মাধবীর আকাশ দেখিয়ে বলেছিলাম‚
“মানুষ হলে এসব দেখে পাবে অনাবিল প্রশান্তি হৃদয়ে।”
জবাবে পেয়েছি‚ “এত সুন্দর যখন মানবজনম;
তুমি কেনো হলে না মানুষ‚ হলে না কেনো অনন্য কেউ?”
আমিই একমাত্র যার কোনো প্রেম হয়নি।
এমন কোনো গ্রহ নেই আমাকে ভালোবাসেনি;
কিন্তু‚ ভালোবাসলেই কি কাছে পাওয়া যায়?
প্রেম মন্বন্তরে ভেসে যাওয়া আমার পুরো সময় ধরে
পৃথিবীর দিকে তাক করে রাখা অনেক মিসাইল দেখেছি আকাশে।
ধর্মের নামে পুড়ে যাওয়া মানুষ মৃত্যুর আগেও মানুষ ছিলো‚
তাঁর হৃদয় খুঁজতে গিয়ে আমি যতটা পেয়েছি স্রষ্টাপ্রীতি ততটাই পেয়েছি পৃথিবীপ্রীতি।
ভালোবাসলেই কি পাশে থাকা যায়‚ যায় কি কাছে রাখা?
যদি
হতাম যদি স্বপ্ন বিক্রির চোরাকারবারি
স্বপ্নহীন মানুষের কাছে স্বপ্ন বিক্রি করতাম চড়া দামে।
কার থেকে জন্ম এসব স্বপ্নের তাঁর খোঁজ রাখা স্পষ্ট বোকামি‚
স্বপ্ন পোষা কভু হয় না নামে।
যদি হতাম দূর পাহাড়ের চূড়া ছোঁয়া তুলতুলে মেঘ
দুর্দম্য কিছু মানুষকে ছুঁয়ে দেখতাম বেলা-অবেলায়।
দেখতাম মানুষের বদলে যাওয়া‚ খোলা জানালা—
বলে দিতাম মিথ্যে যত তাঁদের নিত্য পথচলায়।
আমি কোনো সুদর্শন যুবক হলে নির্দ্বিধায়
প্রেমিকার ঠোঁটে এঁকে দিতাম সুদীর্ঘ চুম্বন এক।
যদি হতাম ক্লিন শেইভড কোনো কর্পোরেট কবি
কাপলেটে রোজ সাজিয়ে নিতাম প্রেমিকার দেহ।
না পাওয়া কিছু বিশেষ সন্ধ্যে ছাড়া ভুলে যেতাম সব‚
ছুঁয়ে দিতাম নিঃসন্দিগ্ধতায় ভুলে সব সন্দেহ।
যদি হতাম শহুরে কোনো চেনা রাস্তার ব্যস্ত ট্রাফিক
থমকে যেতাম রোজ সন্ধ্যায় সূর্য যখন লুপ্তপ্রায়।
হতাম যদি গ্রাম্য দুপুরবেলার কোনো শূন্য প্রান্তর
অপেক্ষাতেই সুর সাজিয়ে বেড়ি পরতাম পা'য়।
তারা-জ্বলা কোনো নিশুতিরাতে হতাম যদি জোনাকি
উচ্ছ্বাস বিলিয়ে সুখ কিনে নিতাম সস্তা দামে।
ধুলো জমা কোনো একুস্টিকের স্ট্রিং হলে
নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গী ভেবে কাঁটাতাম না দিন‚
আশা রেখে রোজ বাঁচতাম কোনো এক গীটারপ্রেমী
আমাকে নিশ্চয়ই ছুঁয়ে দেবে একদিন।
আমি মহাবিশ্বের কোনো নির্জন নক্ষত্র হলে
গভীর রাতে জ্বলজ্বল করতাম প্রেমময় আকাশে‚
সমস্ত সুন্দরীর আবেদনময়ী ডাক উপেক্ষা করে
সাক্ষী হয়ে থাকতাম অসভ্যতার এই ক্রমবিকাশে।
চাতক
উদীয়মান মৌমাছিটি নিজস্ব প্রত্যয় ভুলে গেলে‚
জোনাকপাখি আলো জ্বেলে গন্তব্য ভুলে গেলে
তুমি কি আমার রবে?
আমি তো জানি কেন চাতক বসে থাকে বৃষ্টির অপেক্ষায়
যদি ভুলে যাই এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপেক্ষার হেতু
তবে তুমি কি আমারই রবে?
আমি চলে যেতে চাই তোমার শরীরের স্পর্শ থেকে
অসংলগ্ন পার্থিবতার বাইরে,
চুকিয়ে এই ক্যারাভান জীবন এক অনন্ত রাত্রির ক্যাবারে।
তুমি কি আমায় ফেরাবে?
মহাজগৎ সমান রিক্ততার মিছিলে
সামিল হয়েছে এই রাজধানীর অনন্ত পথ‚
সিক্ততার আড়ালে একফালি নীল চাঁদে সেজেছে রাত্রির রথ‚
একাকীত্বের যেখানে আতুরনিবাস‚
উষ্ণতাই যেখানে আদিম সত্য।
সেখানে ব্যারিকেড ভেঙে ঠোঁটে ঠোঁট রাখবে?
কথোপকথন
রঙ নির্লিপ্তির গোধূলি মিছিলে
শীতের গান বেজে উঠেছে এক আততায়ী সুরে‚
অগ্রাহ্যের ভর্ৎসনায় সময়কে ভাসিয়ে
আমরা পাড়ি জমিয়েছি বহুদূরে।
জীবনের কার্নিশ একমুঠো আদরের বিপ্লবী মেঘ
আমায় গিলে নিতে চাইছে চুপিসারে‚
মনের অন্ধগলি জুড়ে পুষে রাখি অবজ্ঞার যাতনা অভিসারে।
এলোমেলো শব্দের কোলাজে সাজিয়েছি কবিতা—
পংক্তিরা উড়ে যায় মুঠোফোনে‚
জোনাকির নামে আলো জ্বলে ওঠে মগজে ও মনে।
বোধদয়
তোমায় ফেরাতে গিয়ে থমকে গিয়েছি জোনাকির আহ্বানে।
জোনাকির দল জানান দিলো‚
তোমার মন-মগজের ভুল-পোকারা ডুব-সাঁতারে তীর হারালে
সাগর তোমায় ভুল শেখাবে।
তোমার কোমল চোখের জল শুকালে‚ মেঘের ভীড়ে মেঘ লুকালে
সূর্য তোমায় আলো দেখাবে।
তোমার ভুল-ব্যবিলন ভষ্ম হলে ছাই প্রলয়ে শুকনো ঘাসেও
চাইবে আমায় শিশির নামে।
তবু‚ সেদিন তোমায় আপন ভেবে কিনবো না আর প্রেমের দামে।
নিরুদ্দেশ
এক এক করে সমস্ত কবিতারা ছেড়ে গিয়েছে এই মনশ্মশান‚
এই শূন্য প্রান্তরে আমি একা রাক্ষস মাপছি ধোঁয়ার আয়তন।
মহামারি পেরিয়ে যত কবিতার লাইন বেঁচে ছিল
তারাও এলোমেলো ঠিকানা বেছে নিয়ে আমাকে করেছে একা।
যে কবিতা লেখা হয়ে গিয়েছে সে-ও একসময় বিশ্রী রূপ নিয়ে
ধরা দেয় আমার মন ও মগজে।
তাই‚ নতুন কবিতা নিষিক্ত না হলে পৃথিবী শূন্য লাগে।
মনে হয় আকাশে চাঁদ ওঠে না আগের মতো‚
পাখিও গায় না গান চেনা সুরে।
কবিতার উত্তাপে যতবার প্রেয়সীকে পুড়িয়েছি‚
ছাই আর অতলান্তিক ঘৃণা ছাড়া কিছুই আমি পাইনি।
প্রেয়সীর আমাকে ছেড়ে যাওয়ার সূত্র ধরেই হয়তো
আমাকে ভুলে গেল এই একবিংশ শতাব্দীর সহস্রাধিক কবিতা;
যাদের প্রতিটি শব্দের অন্তরালে উৎসর্গের স্থানে বসিয়েছিলাম একটাই শূন্যতাকে।
পৌনঃপুনিকের মতো আমি শুধু শূন্যতা বসিয়ে গিয়েছি
আমার সবচেয়ে প্রিয় সাথীদের জীবন-বৃত্তান্তে।
কবিতারা আজ নিরুদ্দেশ,
ঠিকানাবিহীন অথবা পথ হারানো মরুপথিক।
অসম্পৃক্ত
মানুষের প্রপঞ্চময় স্বাধীনতা নিয়ে কৌতুক করছে বন্দি চিড়িয়ার দল।
ইউফ্রেটিসের তীরে গড়া প্রাচীন সম্রাজ্ঞীর প্রিয় ব্যাবিলন হয়েছে ছাই‚
আমরা কেবল সহিংস পৃথিবীর বয়স গুনে যাই।
কে কতো শিখলো বুলি‚ গিললো শিক্ষা পুস্তকাদি বিশ্লষণে‚
রাখি কড়া হিসাব‚ গরমিলে পিষ্ট করি বিবিধ বিশেষণে।
আমরা বলি আমরা জানি‚ আমরা বলি আমরা মানি
এই সভ্যতার নামে গড়ে ওঠা অসভ্যতার যত আইন‚
অতঃপর বিচারের নাম ফের অবিচারেই টানি।
মেটামরফোসিস এই সময়ের অদ্ভুত নিয়মের বেড়াজালে
শিল্পী মরেছে সুন্দর বুঝে‚ স্বাধীনতা খুঁজে;
আমরা কেবল মনেই রেখেছি মৃত্যুদিবস মুখে হাত গুঁজে।
মনগহীনে লুকিয়ে রাখি ভিসুভিয়াস‚ সন্ধ্যাতারার প্রেমে হয় জল;
আজও জানেনি ভিসুভিয়াস‚সন্ধ্যাতারার বুকে অগাধ ছল।
পেইনকিলারের অভাব
একটা পেইনকিলারের অভাবে ঘুমাতে পারিনি আমি‚
সারারাত একটা অসহ্য ব্যথা শরীরে জাগিয়ে আমিও জেগে ছিলাম।
এ ব্যথা আমাকে ঘুমাতে দেয় না
দেখতে দেয় না নতুন স্বপ্ন‚
ভুলিয়ে দেয় পুরোনো যত স্মৃতি
লিখতে দেয় না নতুন কোন গল্প।
টানা দু’বছর পেইনকিলারের অভাব আমাকে ঘুমাতে দেয়নি‚
কতকিছু এই ধরণীকে বলার ছিলো; বলতে দেয়নি।
কয়েকটা বিষণ্ণ কালো গোলাপের প্রেম
আমাকে দিয়ে যায় পাপড়ির আঘাত‚
সকালের কালো পর্দায় আঁটকে রাখা আঁধার
আমার কাছ থেকে দূরে রাখে রাঙা প্রভাত।
পেইনকিলারের লুকোচুরি বাড়িয়ে দিচ্ছে আমার গোপন অসুখ;
বাড়াচ্ছে ব্যক্তিগত ব্যথা‚
একটা পেইনকিলারে লুকিয়ে আছে প্রেম‚ প্রশান্তি আর অতলান্তিকতা।
স্তব্ধ কিছু কথা বাড়িয়ে দেয় অসহ্য ব্যথা
এনে দেয় উদাস দুপুর‚
আমার হৃদয়ের যত পুরোনো ক্ষত জাগিয়ে তোলে
ঢেউহীন নিরব শব্দের পুকুর।
নিমিত্তে
বেপরোয়া উত্তাপে এই মহাজাগতিক শোকগাথায়
মুক্তির সুর মেলানোর বাসনা অতীতের অভিসন্ধি‚
হঠাৎ গেয়ে ওঠা এই নিশিত গানের অনন্ত বেদনায়
তুমি মৃন্ময়ী মূর্তির ন্যায় আজও — শূন্য উপলব্ধি।
আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত থেকে অশূন্য মহাকাশ
আমাদের নবজাত প্রেমের মৃত্যু চিৎকারে মুখরিত‚
আমার প্রেম জাতিস্মর‚ মুছে ফেলার নেই অবকাশ
ধীর পায়ে মাড়িয়েছো যত প্রণয় শৈশব অঙ্কুরিত।
রঙ-হারানো সন্ধ্যার জোৎস্না বাসরে মুখর আসরে
অবিস্মৃত পংক্তিরা সব মেলে দেয় প্রাচীন মুক্ত ডানা‚
সেই ডানাতেই ভর করে শুধু খুঁজে ফেরে অবসরে
বিস্মৃতা প্রণয় রমনীর যতটুকু আছে চেনা-জানা।
রৌদ্রস্নাত দুপুরের দক্ষিণ খোলা জানালায় আমরা
দু'জন দ্বৈত-ব্যক্তিগত ব্যথাকাতরতা নিয়ে আছি‚
হঠাৎ‚ একরাশ ঠিকানাবিহীন বাতাসে উত্তাল কামরা
এ বাতাসে খেলা করে সুখ‚ এ বাতাসে বাঁচি আমরা।
তাঁরবিহীন যোগাযোগে একে অপরের জন্য কান পাতি
শ্যামল দেহের নীচে শীত খেলা করে তখনই ভীষণ‚
যানজট পেরিয়ে তুলি মুঠোফোন - ফেলে সাঁঝবাতি
অনন্ত সাধে বহুদিন বাদে সেই তীব্র শীতের অন্বেষণ।
সুদূর অন্তরিক্ষে নীল মেঘের খামে তোমার নামে চিঠি
সূর্যের আদিম উত্তাপে পুড়ে ছাই; অক্ষরমালা হয় শেষ‚
পারষ্পরিক বোঝাপড়ার সাক্ষী নক্ষত্ররা জানে ঠিকই
আমাদের সব ব্যক্তিগত ভিন্ন গন্তব্যের একই অবশেষ।
শুভ্র কাশের নীড়ে নীল রাত অবলীলায় যায়-আসে
সৌন্দর্যের বিতৃষ্ণায় ভবঘুরে এককাপ গরম চা-য়ে
বুকপকেটে তোমায় দেখার স্বপ্ন নিয়ে বাঁচি দীর্ঘশ্বাসে
এই অন্তহীন দীর্ঘশ্বাসে বেঁচে থাকা দুঃখ-সুখের দায়ে।
আমার ভালো থাকায় তোমার রেখে যাওয়া স্পর্শদানা
আরও সুখের প্লাবন এনে দেয় রুক্ষ জীবনে আমার‚
তোমার স্পর্শের আদেশে আমার খারাপ থাকা মানা
নির্ঝর স্বভাবের শুদ্ধতায় মোড়ানো স্পর্শ তোমার।
নাগরিক রূপকথায় ঢেকে দেওয়া চেনা বিদীর্ণ শহর
শিশুহারা মায়ের ছাপা নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তির আড়ালে
চাপা পড়ে যায় তোমার নিমিত্তে আমার দুঃখ বহর।
এই দুঃখ পারষ্পরিক গোলযোগ‚ দুঃখ আর সুখের।
অস্পষ্ট আলোয় তোমাকে দেখেছি‚ তোমাকে এঁকেছি
মিহিদানা সন্ধ্যায় তুমি কেনো অকারণ দূরত্ব বাড়ালে
তোমাকে খুব কাছ থেকে ছুঁয়ে দেখবো বলে ডেকেছি।
অজস্র পড়ন্ত বিকেল সন্ধ্যের মাঝে নিরবে ডুবেছে।
ক্যাফেটেরিয়া জীবনের লালরঙা কৃষ্ণচূড়ার চাদরে
আমি বাঁচি তোমার প্রেমে‚ বাঁচি তোমার অনন্ত আদরে‚
ধূসর বিষন্ন গোলাপে; মৃত পাপড়ির নির্যাস রক্ত-লাল
আমি পেরিয়ে যেতে চাই দুঃসহ অস্তির স্মৃতি-জাল।
অর্থহীন যৌবনে জেনে গিয়েছি অলীক এ চরাচর
এই পথচলায় তুমি স্ত্রী বাচক হও শব্দে চির-সহচর।
দুঃখ-মুক্তির রঙিন চিঠি নিয়ে কোনো টাট্টুঘোড়া
দ্রুত পায়ে আসুক আমাদের ব্যক্তিগত ঠিকানায়‚
তোমাকে মনে করে বৃষ্টিতে ভেজে এই চোখ-জোড়া
ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়‚ ঘটনায় অথবা দুর্ঘটনায়।
বর্ণপরিচয়
তুমি আমার চেয়ে শুচিবায়ু, খুঁতখুঁতে আর বেরসিক মানুষ হয়তো আগে দেখোনি।
মধ্যরাতের ক্লান্ত অবেলায় কিংবদন্তি'র কণ্ঠে রাত্রিজয়ী কবিতাও হয়তো শোনোনি।
তুমি শুনেছো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মোটরযানের হর্ণ‚ কিশোরীর আর্তনাদ‚
তোমাকে নিয়ে মানুষের গোপন ভাবনা‚ মা হারা সন্তানের অপ্রাপ্তির পসরা।
তুমি দেখেছো শিশুর চোখে হঠাৎ জ্বলে ওঠা বিধ্বংসী আগুন‚ হৃদয়ের পূর্ণতা থেকে শূন্যতা‚
আমার দোষ-গুন আর তোমাকে এড়িয়ে চলা?
মধ্যবয়সী সূর্যের যত মৃত ভাই-বোন এই নক্ষত্রের সন্তানকে চেনে না।
সেমিনার‚ সভা‚ আড্ডাসহ যত কবি-সমাবেশ আছে সেখানে কবিতাকে ভুলে যায় কবিরা।
বেদনাময় রাতে প্রেয়সী ভুলে যায় প্রেমিকের ঠোঁটে ঠোঁট রাখতে।
এই যে ভুলে যাওয়ার অনুরণন‚ সব অকবি হয়েও আমি দেখি।
তাই‚ আমি ভুলিনি আমার কবিতা।
আমি দেখেছি শিমফুলের পাশে তোমার আশ্চর্য ঠোঁট‚
বিস্তৃত সাদাকালো অসহ্য স্নিগ্ধ চোখ‚ আমার আঙুলের ফাঁকে আঙুল তোমার।
আমি অনুভব করেছি তোমার নিঃশ্বাসে বিশ্বাসের ফুলেল বাগান‚
তোমার জড়িয়ে ধরায় ভালোবাসার গন্ধ‚ তোমার হৃদয়ের সিস্টোল-ডায়াস্টোল‚
আমার হাতের মাঝে তোমার কোমরের তুলতুলে মেঘ।
আমি শুনেছি তোমার হাসি‚ কণ্ঠস্বর‚ শিশিরের ঝরে পড়ার শব্দ‚
তোমার প্রসাধনীর মুখে তোমার প্রশংসা‚
তোমার সমস্ত্র পরিধেয় বস্ত্র এবং ব্যবহৃত বস্তুসমূহের সৌভাগ্যের গল্প।
ওরা তোমাকে রোজ আলিঙ্গন করে‚ আমি পারি না। হিংসে হয় খুব।
নিরব দেয়ালেও শব্দের প্রতিধ্বনি বলে কিছু থাকে।
তেজস্ক্রিয়তা
পৃথিবীর আজ নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম‚
আমরা বেঁচে চলেছি ইচ্ছাতে অথবা অনিচ্ছায়‚
পৃথিবীর ফুসফুসে ধোঁয়া ওঠা ভাতের উত্তাপ জমা;
আমাদের দেখা হবে কোনো অনাবিষ্কৃত দ্বীপ বা গ্রহে।
তুমি ক্ষুদ্রপ্রাণ এক‚ পৃথিবী-দহনে নিয়েছো রাজার পাঠ‚
পৃথিবী মানে বাসভূমি তোমার‚ ঘর-বাড়ি-জীবন-চৌকাঠ।
ফ্যাকাশে অশূন্য আকাশে মেঘ হয়ে যায় বর্ণমালা‚
আমাদের রংধনুহীন দিনগুলো সব রাতের সমান;
অতীতের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রমালা হারিয়েছে ঔজ্জ্বল্য
অনন্ত দৃশ্যমান মলিন রাত‚ আলোশূন্য আঁধার।
বৃক্ষহীন জনপদ যেন আশীর্বাদহীন নাগাসাকি‚
গলে যাওয়া বরফের দেশে ভেসে যায় আপন শহর;
প্রতিপত্তির ভিড়ে হৃদয় নগরী আজ শূন্য ব্যাবিলন
মিথ্যে বাঁচার লড়াইয়ে দেখো পৃথিবী ধ্বংসের বহর।
মানুষ-ই অধিকতর তেজস্ক্রিয়!
হোক প্রতিবাদ
তুমি শিখিয়েছো কি ছিলো ঠিক, আমার কি ছিলো ভুল
লিখিয়েছো গল্প নিজের মতো‚ হৃদয়ে বিঁধেছো শূল
কিসের সত্য খুঁজে মরি
একাকী আমি এই লাশকাটা ঘরে
কোন মোহে মাতাল তুমি
করিয়েছো নিশিত ভুল অগোচরে।
খোলো আজ নীমিলিত চোখ‚ মুছে ফেলো অতীতের শোক
বলো আজ সত্যের কথা‚ হলে হোক প্রতিবাদ হোক।
আমি শিখেছি বলতে সত্য
শিখেছি যা ছিলো তোমার কথ্য
আমি চিনেছি তোমায় আজ
খুলেছে তোমার মিথ্যে সাজ
কেনো দেখালে সে পথ
যে পথে রুখে দিলে নিজে
হারিয়ে পথ আমি আজ আলো খুঁজি মিছে...
খোলো আজ নীমিলিত চোখ‚ মুছে ফেলো অতীতের শোক
বলো আজ সত্যের কথা‚ হলে হোক প্রতিবাদ হোক।
তুমি শুনছো আমায়?
দেখছো আমায়?
রাখছো আমার খোঁজ?
ভাবছো তুমি ঝরছে কত নিষ্পাপ প্রাণ নিমেষেই রোজ?
কেনো রুখছো আমায়?
তুমি বুঝছো আমায়?
তুমি যে থেকেও আজ আমার মধ্যে নিখোঁজ...
খোলো আজ নীমিলিত চোখ‚ মুছে ফেলো অতীতের শোক
বলো আজ সত্যের কথা‚ হলে হোক প্রতিবাদ হোক।
টেন্ডস টু জিরো
আমি তোমাকে নিয়ে আর ভাবছি না‚
ওই চোখেতে চোখ আর রাখছি না‚
কোনো টেন্ডস টু জিরো নিয়ে লিখছি না।
কোনো মিথ্যের দোষ গায়ে মাখছি না
দুঃস্বপ্নের ঘুম ভাঙা রাতে আর
তোমার পাশে আমি থাকছি না
কোনো নির্ঘুম রাতের শেষভাগে
মৃত্যুর শোকগাথা লিখছি না।
না না রাখছি না আর তোমার কাঁধে মাথা‚
ভাবছি না আর তোমাকে নিয়ে যা-তা।
মিথ্যের দিকে ধাবমান কোনো
সত্যের পথ ধরে চলছি না‚
শৈশবে শিখে বহমান কোনো
অসুস্থ শখ ভালো বলছি না।
অবেলার বাদর* দিনে
সমবায় ছাতা মেলে ধরছি না‚
কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ভুলে
মুক্তির সুপারিশ করছি না।
রোজ বেঁচে চলা অবাধ্য করাল
কোনো অভ্যাসের দাসত্বে গলছি না‚
গোটা জীবন পুড়িয়ে ফেলা কোনো
প্রাচীন আগুনে আমি জ্বলছি না।
শোক — একটি উদযাপনের বিষয়বস্তু
কতশত শোক সমাপতনে অগণিত হাসিমুখ অবাধ্য সূর্যের মতো দৃশ্যমান হয়।
বেশ ক'বছর আগে ফেব্রুয়ারি'র একুশে শোকার্ত ফুলের বিনিময় অবলোকন করেছিলাম কৈশোর-প্রেমের নিমিত্তে।
অবাক হয়েছিলাম সেবার।
তারপর দিন গেল‚ মাস গেল। এলো সভ্যতার বর্বরতম কালোরাত।
শোকপ্রকাশ বলতে অর্ধনমিত একটুকরো বাংলাদেশ আর পাঠদান বন্ধই চোখে পড়লো।
আমি শিখে এসেছি শোক অর্থ শিক্ষালয়ে পাঠদানহীন মজাদার সময়।
একটুকরো অবসর এনে দেয় যেকোনো শোকদিবস।
যত শোকার্ত নিরবতা পালন দেখেছি অধিকাংশ জায়গায় আমি হাসি-ঠাট্টার সাক্ষী হয়ে গিয়েছি।
গিলোটিনময় দিনগুলো ভুলে যেতেই পারে ফ্রান্স।
আমরা কী করে ভুলি পঞ্চাশ পেরোতেই ত্রিশ লক্ষ শহীদকে!
“হ্যাঁ‚ অতীত আঁকড়ে সামনে এগোনোকে অনেকে সমর্থন করবেন না।
বেশ তো‚ একদম বাদ দিন।”
শোককে উদযাপন আর উপভোগের প্রসঙ্গ বানিয়ে ফেলা তো ভীষণ অন্যায়।
সে যা হোক‚ এতকিছুতেও আমার খারাপ লাগেনি বিশেষ।
কিন্তু‚ সেদিন আমার শোকসভার সামনের সারিতে বসে
কলহাস্যে একজন মেয়ের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করছিলেন।
খানিকটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে ব্যথা পেয়েছিলাম।
অবাক হইনি আর, বোধদয় হলো।
আসলে‚ শোক একটি উদযাপনের বিষয়বস্তু।
নাগরিক জার্নাল
গ্রাফিতি হতে কিশোরীর ছুটে চলা মেঠোপথ
আর মর্গ থেকে সোজাসুজি নরকের যাত্রাপথ
যথাক্রমে মানুষ ও আত্মায় পরিপূর্ণ।
গ্রাফিতির শহরে প্রতিটি ধুলোজমা পায়ে মিশে আছে অবসাদ
ওদের হৃদয় খুঁজলে পাওয়া যাবে অবসন্নতা‚ অপ্রাপ্তির বিশাল রাজ্য
তবু ওরা বেঁচে থাকে‚ বাঁচার চেষ্টা করে চলছে অনবরত।
শহরের অন্যপ্রান্তে সুদর্শন যুবক
লাল-নীল রঙে রাঙিন সহস্র স্বপ্ন প্রেমিকার হাতে গুঁজে
মৃত্যুর অন্তহীন অপেক্ষা করছে।
কেউ আবার এই নির্বাসনে কলমের ডগায়
প্রেমিকাকে বসিয়ে বানাচ্ছে কতকিছু,
লিখছে কতশত গান-গল্প-নাটক-কবিতা।
শোনো এই বিকেলের কথা,
অনিন্দ্য সুন্দর বিষ্ময়ে ডুবে থাকা এই বিকেল।
শেষ বিকেলের শেষ রোদে শেষ রৌদ্রস্নান অনিন্দ্য সুন্দর।
আবার কোনো বিকেল একাকী হয়।
আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষটি এই সময় কল্পনায় প্রিয়তমার পাশে বসে থাকে।
হঠাৎ অবাস্তব ওই অবয়ব অদৃশ্য হয়ে যায়।
তখনি একটি তারা খসে পড়ে।
স্বেচ্ছায় খসে পড়ে।
ওই তারার খোঁজ আকাশ কভু রাখে না।
রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠগুলো সব প্রেমিক-প্রেমিকায় পূর্ণ থাকে।
তাঁদের চুপিচুপি সতর্ক আলাপনে মাঝেমধ্যে জোনাকি আসে সঙ্গ দিতে।
ওদের গল্প শোনে জোনাকি।
আবার অনেকেই এসময় হলরুমে বসে বসে বুকের আজন্ম অমাবস্যার সাথে সন্ধি করে।
পূর্ণিমার আলো ঘরে আসার আগেই তাকে গ্রাস করে ফেলে অন্ধকার।
কুচকুচে কালো অন্ধকার।
আনন্দধারা বয়ে যাক প্রতিটি মানুষের জীবনে।
ক্লান্তির ক্লান্ত ডানা
উদীচীর শিয়রে এসে সায়াহ্ন জমেছে
উপমা কবিতার পসরা বসেছে
কুজ্ঝটিকায় চারিপাশ শুভ্র অন্ধকার
নিশ্চল আকাশে মেঘে-রাও চুপ।
অযথা ঘনঘটায় মিলিয়ে ভালোবাসা,
ক্লান্ত সন্ধ্যায় ক্লান্তির ক্লান্ত ডানা
অমোঘ অনুরোধে নিত্য নিরব
ঝিঝি-রাও দিয়েছে নিরবতায় ডুব।
দুঃসহ বেদনা বেঁচে আছে অবয়ব শরীরে
মৃত্যুর সমঝোতা জেগে আছে সমঝোতা স্মারকে
সংকীর্ণ বাতায়নে এসে থেমে গেছে হিমেল বাতাস
আমি শীত তৃষ্ণায় করছি অগ্নিস্নান।
নীমিলিত চোখ মেলে দেখি আধার গ্রাস করেছে সব
সান্ধ্য মাধবীলতার গন্ধ আসে নাকে
ছুঁতে গিয়ে হারিয়ে ফেলি বিস্মৃত বাঁকে
সহস্র বিস্মৃত কবিতা হারিয়েছিলাম যেথায়।
প্রেয়সী তুমি চাইলেই এনে দিতে পারো শীতল বাতাস
আধারের বুক চিরে একজোড়া তুষার চোখ।
মুছে দিতে পারো নিরবতা সব
বিলীন করে দিতে পারো এই কৃষ্ণ কূপ।
এনে দাও এই তৃষ্ণার্ত শরীরে অবাধ্য জলপ্রপাত
এক আকাশ জোৎস্না প্লাবিত রাতে জোনাকির আলাপন
অচেনা শহরে নিরবে হারিয়ে যাওয়া প্রেম,
অতলান্তিক নিশ্চয়তায় ভরা ভালোবাসা।
ক্যামেলিয়া
ক্যামেলিয়া‚ মনে করো এক জোৎস্না ধোয়া রাতের বুক চিরে আমরা এগিয়ে চলেছি ক্রমশ অতীতের দিকে। তোমার মনখারাপ হলেও ভীষণ সুখ অনুভব হচ্ছে নিশ্চয়ই। তুমি আমাকে বর্তমানে রাখতেই চাও না। তুমি সারাটা সময় এক নির্জীব ফুলের মোহে মাতাল। ইহজাগতিক কিছুই তোমার এই মাদকতা কমাতে পারে না। আমার প্রেমের আকাশের মেঘ তুমি দেখছোই না।
দ্যাখো একটি ফুল মরছে ধুঁকে‚ কাঁপা বুকে
অভাবে বাঁচে তোমার স্পর্শদানার‚
এই শতাব্দী আর মিলেনিয়ামে দিয়েছো রুখে
বুঝি বাকি নেই গল্প জানার।
তবু আমার গল্পে আজও আমি রেখেছি তোমায়‚ ক্যামেলিয়া...
তোমার ভীষণ অসহ্য এই বর্তমান। আচমকাই বাতলে দাও আমার ভবিষ্যৎ। কারও কারও লাল তরঙ্গের আগমনীতে বদলে দাও অতীত অবধি। আমি কখনওই পারি না তোমাকে বর্তমান চেনাতে। আমাকে চেনাতে। আমি পারি না বোঝাতে তোমায় কেনো কবিতা আসে না আমার রাত্রির নিরবতা জুড়ে।
এই যুগে বেঁচে থাকো‚ কত জ্বেলেছি আলো
এবার নিজেই চিনে নিও মন্দ-ভালো।
একা রাতে কবিতার প্রহর আজ ধূসর কালো
অবহেলাতেই তুলে নিও শব্দগুলো।
তবু কবিতার শরীরেই আমি রেখেছি তোমায়, ক্যামেলিয়া...
তোমার চালাকির সামনে আমি নতজানু বসেছি যতবার‚ তুমি আমাকে অনুভবই করোনি। এই যে এখনও তোমাকে ভেবে আমার কিছুই লেখার কথা না। অথচ... অথচ‚ কী দুর্বার চলছে এই হাত!
তুমি সেই সুখে ভাসো জানি‚
যে অসুখে আমি পুড়ে যাই।
দেয় সেই মুখ হাতছানি
যে মুখে প্রেম খুঁজে পাই।
তোমার না থাকাটুকু জুড়েও আমি রাখি তোমায়, ক্যামেলিয়া...
ঘৃণা
আমি কি আমার জন্মকে ঘৃণা করছি?
মহাপৃথিবীর একই গ্রহে জন্মেছি, একই ভূ-খণ্ডের শস্যে-তৃণে-মৎসে বেড়ে উঠেছি বলে মন-মগজে ধর্ম-সমাজ-দর্শন যুদ্ধ চলছে অবিরত।
নেহাতই রক্তপাতহীন এসব যুদ্ধ যে খুব একটা অর্থবহ নয় এটা স্পষ্ট।
এ থেকে সম্ভবত ঘৃণার সীমারেখার দূরত্ব ঢের!
আমি কি আমার রক্তকে ঘৃণা করছি?
সমবর্ণের রক্তস্রোত আজ এক অবাক বিষ্ময়।
অথর্ব গণতান্ত্রিক এই দেশে রক্তের কোনো বিনিময়প্রথা চালু নেই,
এর পিঠাপিঠি জন্মেছে অজস্র
প্রাণোচ্ছল
নির্ঘুম
রাত্রিযাপন।
অথচ, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে বোধহয় অ্যাপোলো!
আমি কি ঘৃণাভরে দেখছি নিজের দেশকে?
যে সার্বভৌমত্বের জোরে নিজেকে বাংলাদেশী বলি,
সেখানেই খোলা-বুকে সহস্র বুলেট তার বসতি গড়ছে।
অগনিত অনিয়ত বুলেটের বেড়াজালে আবদ্ধ আমি—
শুধু নৈঃশব্দে স্তব করছি,
‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না,
এই জল্লাদের উল্লাস-মঞ্চ আমার দেশ না।’
সম্ভবত এসব অর্থহীন স্নায়ু-মৈথুনকেও তুমি ঘৃণা বলতে পারো না।
ফেব্রুয়ারির দেশে
আমি তোমাকে আমার ভালো থাকা বলে জানি
তুমি এসে বসো পাশে
ভাবি রোজ সকালের ফুলে সাজা ফুলদানি
ঘিরে থাকো সুবাসে
তুমি এলে তবে দুঃখরা কেনো আসে
আমায় কি ওরা ভীষণ ভালোবাসে...
আমি ভাবি রোজ তুমি এলে হবে ভালো
আঁধার সরিয়ে জ্বেলে দেবে কোনো আলো
আমি ভাবি তুমি ভীষণ শীতের দিনে
আমায় ঘিরে উষ্ণ আদর জ্বালো
এমন কঠিন ফেব্রুয়ারির শেষে
তুমি এসে ফের আমার পাশেই বোসো...
তুমি এলে আজ হৃদয় কেঁপে ওঠে
এই বুঝি আমি দুঃখ পেলাম আবার
মেঘ জড়ো হয়, অনাদরও বেশ জোটে
আমি পথ খুঁজি হারাবার...
ভালো আছি বলে নির্বাক রাখি তোমায়
ভালো নেই আমি তোমায় ভালোবেসে
এমন কঠিন ফেব্রুয়ারির দ্বেষে...
মিথোলজির শূন্য ডানা
শুকিয়ে গেছে পুজোর ফুল
বৃদ্ধ রাত‚ জ্বর বাড়ছে তুমুল।
পার্বনের বাংলায় প্রেমই এক বিশেষ পার্বন
আরাধ্য তুমি— নয়নতারার অদূরে ফুটে আছে হাসনুহানা
একটু বাদে সপে দেবে আত্মজীবন আমার তৃপ্তির নিমিত্তে
তবু নেই ব্যথাহীন দিন‚ মিথোলজির শূন্য ডানা‚ অবসাদ করে ভর।
"তুমি যাকে অশ্রু বলো
আমি বলি দুঃখ-নদী।"
তুমি আসলেই আসে লিপইয়ার‚ আমি বলি অধিবর্ষ
তোমরা জানিয়েছো ফেব্রুয়ারী‚ আমি জেনেছি ফাল্গুন।
ফাগুনের বাতাসে যে আগুনের আনাগোনা তাতে
আছে ফিনিক্স বা আগুনপাখির দ্বিধাহীন যাতায়াত।
আমি জানি ওদের কাহিনি‚
তোমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস বা জীবনচরিত নিয়ে
আমি বিন্দুমাত্র মনোযোগ দেখাইনি কখনও।
